Human Rights violation by state: Bandiram-er Ganatantra (বন্দিরামের গণতন্ত্র )

Bandiram-er Ganatantra (বন্দিরামের গণতন্ত্র )

This film is about the mindless  human rights violation by the police especially in the adivasi regions of Belpajari, West Bengal. Adivasis are regularly harassed, tortured and picked up for being ‘Maoists’. The film made in and around 2002-2003 captures the police atrocities which has culminated in the present explosive situation in the region of Lalgarh-Belpahari beginning from the end of 2008. The film also touches upon the death of urban youth Abhijit Sinha who committed suicide unable to bear the mental strain of regular police harassment, falsely accused of being a Maoist.

The film is in Bengali (বাংলা) but has english subtitles.
Director: Sitanshu Sekhar
Contact:  s.sitansu@gmail.com

State oppression and protest in Midnapore: Dreams in the time of Terror (সন্ত্রাসের সময় স্বপ্ন)

Dreams in the time of Terror (সন্ত্রাসের সময় স্বপ্ন)

This film made alongside Bandiramer Ganatantra (বন্দিরামের গণতন্ত্র) dwells on the topic of police atrocities on the indigenous adivasis of the Belpahari region of West Midnapore, West Bengal. The film focuses on the targeting of women folk by the police often resulting in torture and sexual abuse. Several incidents have been re-enacted in this film accompanied by the newspaper reports that appeared during that time. This entire episode of rights violation by the police continued unhindered in the name of hunting down Maoists.

The film is in Bengali (বাংলা) but has english subtitles.
Director: Nilanjan Dutta
Contact:  nilanjan123123@rediffmail.com

Slum Eviction in Calcutta: (In)visible Calcutta [(অ)দৃশ্য কলকাতা]

(In)visible Calcutta [(অ)দৃশ্য কলকাতা]

This film captures the eviction of the rail colony slums around Dhakuria lake, by the rail lines. The eviction took place in 2005 as the slum was maligning the beauty of the posh region by the South Calcutta Lake. And moreover the slum dwellers were accused of encroaching on land that was not theirs and also polluting the Lake. The film maker was also directly involved in protesting the eviction and stood by the struggle for years at a stretch and documented the same.

The film is in Bengali (বাংলা) but has english subtitles.
Director: Pramod Gupta

Story of Lalgarh Movement: Hool (হুল)

Hool (হুল)

The Lalgarh region in West Bengal has been the scene of recent hostilities between the state police forces and the native people over the issue police atrocities. In response to massive police atrocities committed by the police, people of Lalgarh have taken up the initiative and organised a mass uprising driving the police out of the Lalgarh area. The region was cut off and isolated by the people of the region and beyond the authority of the police. We have made this film centring on this mass uprising through interviews, dialogues and events that have unfolded in the recent past. The issue however, has not abated and still continues to be one of the most important areas of disturbance in the state.

The Bengali (বাংলা) version without subtitles can be found here:

http://vimeo.com/9386641

This film was completed within February-March 2009, long before the joint forces entered Lalgarh in June 2009. The film tries to capture the spirit of the movement as it began. It highlights how this movement was characteristically completely different from any other movement of the recent past in Bengal viz. the Singur and Nandigram movement. This movement was not to protect land but was to claim dignity and the fundamental rights of the indigenous population of the region.

Singur Struggle: Right to Land (আবাদ ভূমি)

Right to Land (আবাদ ভূমি)

This film explores the land debate arising out of fertile land acquisition in Singur for the Tata Motors small car plant. The film traces the roots of the movement the ensued the land acquisition process.

The film is in Bengali (বাংলা) but has english subtitles.
Director: Partha Sarathi Banerjee
Contact:  psb3210@yahoo.co.in

ছবির ক্যানভাসে

ক্যানভাস পত্রিকা, ২০১০, কলকাতা বইমেলা সংখ্যা থেকে

‘দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ’ কিংবা ‘পড়েছ যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে’—দুটো একই কথা! এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাবধানবাণী বা সাদা বাংলায় থ্রেট! দেশ-কাল-পৃথিবী জুড়ে চলছে চলবে আর্থিক মন্দা আর মূল্যবৃদ্ধি, লক্ষ কোটি মানুষ রাতারাতি কর্মসংস্থান আর বেঁচেবর্তে থাকার বৃত্ত থেকে বিলকুল আউট! বহুজাতিকদের হাতে দেশের জল-জঙ্গল-জমি লুঠ, শহর থেকে বস্তি হঠে যাচ্ছে-জডলে যাচ্ছে দৃশ্যমান পে-লোডার বা অদৃশ্য নেক্সাসের জোরে, আর বেশি ট্যাঁফো করলেই পুলিশী আঁচড়, ইউএপিএ-র সীলমোহর  কিংবা উর্দিধারী বা উর্দিবিহীন পুলিশের গ্রীণহান্ট অথবা সুর্যোদয়ের মত অপারেশন গরম সীসা ঢেলে দেবে প্রতিবাদীর বুকে। শ্রমের মর্যাদা রচনাটা আর বাজারী রচনা সংকলনেও পাওয়া যায় না, শ্রমিকরা ধুঁকছে বন্ধ কারখানার শবের ওপর। শপিং মল বা আবাসনে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুর সারতে আসছে লক্ষ লক্ষ টাকা গুনাগার দেওয়া প্রাইভেট কলেজের ছাত্রছাত্রী। এভাবে এই সমকালটাকে বর্ণনা করতে গেলে একটা নিস্তব্ধতা লাগবে? ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতার মত। ক্রমশ ফারাক বেড়ে চলেছে বিত্তবান আর বিত্তহীন, অত্যাচারী আর অত্যাচারিতের, মালিকশ্রেণী আর ব্যাপক মেহনতী জনতার। এরকম একটা সময়ে পক্ষ আমাদের নিতেই হত, আমরা তাই নিয়েছি। জমি-ইজ্জত-রুটি-রুজি-আইডেন্টিটি বা মানবাধিকার রক্ষা বা প্রসারের প্রশ্নটা তীব্রভাবে আবর্তিত হচ্ছে এই সময়টাকে ঘিরে। আমরা এহেন একটা সময়ের সহনাগরিক, এরকম সব লড়াইয়ের সহযোদ্ধা। অবশ্য এরাজ্যে ‘পরিবর্তনে’র গন্ধে ম ম করছে চারদিক, কিন্তু সত্যিকারের পরিবর্তন কী? হালফিলের পরিবর্তনটা কী আনবে সঙ্গে করে? … থোড়বড়িখাড়া খাড়াবড়িথোড়-এর চেয়ে ভালো কোন সমাধান চর্মচক্ষুতে ধরা দেয় না। অতঃপর আবার হাতে রইলো রাসা। স্ব??, বিশ্বাস আর প্রত্যয়ের রাসা? পরিবর্তনের সত্যিকারের সূর্য অভিযানের দিকে।

প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কলম ধরে কেউ, কেউ অস্ত্র। বুক চিতিয়ে ব্যারিকেড গড়ে মানুষ শোষণ-জুলুম-অসাম্যের বিরুদ্ধে। আমরা, যারা ‘ক্যানভাস’ করছি বা আরো সমমনস্ক যারা এই সময়ে দাঁড়িয়ে নানারকম তথ্যচিত্র বানাচ্ছি, আমাদের একটা সাদৃশ্যের বাঁধুনি আছে। এই বইটা এরকম বেশ কয়েকজনের উৎসাহ আর সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল। এই যে আমরা— মিছিলের স্লোগান, দেওয়াল জুড়ে লেখা, পোস্টার-লিফলেট-পত্রিকা, চোঙা ফুঁকে বক্তৃতার সাথেই বেশী অভ্যস্ত, হাত থেকে হাতে বুক থেকে বুকে দিনবদলের ইস্তাহার ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্রতী আর তাই আর পাঁচটা মাধ্যমের সাথে আমরা বেছে নিয়েছি এই তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারী কিংবা টুকরো টুকরো বিকল্প খবর বানানোর মাধ্যমটাকে। নিরপেক্ষতা একটা কঠিন শব্দ, এরকম বেআক্কেলে সময়ে আমরা তাই তার ধার ধারিনি। পক্ষপাত আমাদের একটা আছে— সেটা এই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থার উচ্ছেদ চাই আমরা। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নামক সংগঠিত মানুষমারা ব্যবস্থাটা বদলে দিয়ে একটা অন্য সমাজ চাই আমরা। আমাদের, আমাদের বন্ধুদের ছবিগুলো সেই লক্ষ্যেই।

সেই লক্ষ্যেই হ্যান্ডিক্যামে ছবি তোলা, বাড়িতে বসে এডিট করে, যা যা বলতে চাই, দেখাতে চাই জুড়ে দিয়ে একটা ডকু বানিয়ে তারপর প্রজেক্টর দিয়ে সেই ছবি জমজমাট রাস্তায় পর্দা টাঙিয়ে, স্কুল-ক্লাবঘরে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর সাদা আর্টপেপার সেঁটে বা নিতান্তই গাঁয়ের বাড়ির মাটির দেওয়ালে মানুষের সামনে দেখিয়ে ফেলা। প্রতিবন্ধকতা অনেক। তবু অডিও-ভিস্যুয়াল মিডিয়ার প্রভাব কতটা ব্যাপক হতে পারে, তা তো আমরা গত কয়েক বছরে টের পেয়েছি, তাই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। মিডিয়া ব্যুমের যে কালপর্বের মধ্যে দিয়ে আমরা চলছি, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব তো অডিও-ভিস্যুয়াল মিডিয়ার। এবং তার সর্বত্রগামিতা, সহজলভ্যতা তথা সর্বজনগ্রাহ্যতা আরও সহজ করেছে মিডিয়ার জয়যাত্রাকে। ছাপার অক্ষরের বেদবাক্য এখন তার জয়পতাকা হস্তান্তর করে দিয়েছে অডিও-ভিস্যুয়ালের লাইভ দেখার কাছে। তাকে অস্বীকার করাই খুব কঠিন।

ভিডিও অ্যাক্টিভিজম সমাজের হেজিমনির বিরুদ্ধে কোন হাতিয়ার হতে পারে কিনা— এ নিয়ে বিতর্কটা অনেকদিনের। আমরা প্রযুক্তির সাহায্য নিলে, শাসকরা একশো গুণ প্রযুক্তির সাহায্য নেবে। আমরা এই কাজের জন্য চেয়েচিন্তে এক টাকা ঢাললে, মালিকশ্রেণীর লোকেরা একশো টাকা ঢালবে। এটা কেউ স্পষ্ট বুঝতে পারলে তাকে অন্তত প্রশ্ন করতে শিখতে হবেই কর্পোরেট বা সরকারী উদ্যোগগুলিকে। হাজারো কেবল চ্যানেল আছে, কোনটাই জনগণের উদ্যোগে চলে না, চলে পুঁজি খাটানো মালিকের পয়সায়। লক্ষ ছবি তৈরী হয়, এক-দুটো বাদে সবই কোনো না কোনো হোমড়াচোমড়া প্রডিউসার  ফিনান্স করে। ফলে যে মালিক-কর্পোরেট-পুঁজিপতিরা গোটা দুনিয়াকেই কিনে নিতে চান, তারা যে এরকম চ্যানেলগুলোকে বা ছবিগুলোকে বা তাদের বানানেওয়ালাদের কিনতে চাইবে, কিনতে চাইবে সব দক্ষতাগুলোকে, তাতে আর আশ্চর্য কি?

আমাদের শুধু প্রশ্ন করতে হবে, তাদের নিরপেক্ষতার ভেককে। ঐ সরকারী বা কর্পোরেটদের নিরপেক্ষতা নেই, থাকার প্রশ্নও নেই। আর তাই আমাদেরও নিরপেক্ষতা নেই, আমরা কায়েমী স্বার্থের অবসান চাই। আর তাই একাজ করতে গেলে সরকারী অনুগ্রহ, কর্পোরেটদের ফান্ড বা এনজিওদের অনুদান পরিত্যাগ করে চলতে হবে। এনজিওদের কথা বললাম কারণ তারা সমাজের আমূল বদলের কোনো দিশা দেখে না, দেখায়-ও না, তাই প্রতিবাদ করে বড়জোর, প্রতিরোধ করে না। তাই কানাগলিতে হারিয়ে যাওয়ার বদলে আমরা বরং থাকবো প্রতিরোধের ব্যারিকেডেই— কখনো ক্যামেরা, কখনো প্রজেক্টর, কখনো ঝান্ডা, কখনো বা শুধুই মুষ্টিবদ্ধ হাত আমাদের অস্ত্র। আমরা সাহায্য পাচ্ছি বহু মানুষের। আমরা তার জন্য কৃতজ্ঞ। আমরা বন্ধু পাচ্ছি অনেক। আমরা আশাবাদী তা নিয়ে। আসুন, হাতে হাত ধরে পার হবই এই বিষের বিষাদসিন্ধু।

মাতৃভূমির খোঁজে: গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন

ক্যানভাস পত্রিকা, ২০১০, কলকাতা বইমেলা সংখ্যা থেকে

শাসকরা বলে বাংলা ভাগের চক্রান্ত।  পাহাড়ে দাবীটা কিন্তু একশো বছরের পুরনো। সমর্থনের ঢল সেখানে নিরঙ্কুশ। নিপীড়িত জাতিসঘার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নটাকে সামনে এনেছে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন। ক্যানভাস-এর পক্ষে ছবি তুলতে গিয়ে সেই অনুভূতির কথা লিখছেন শমীক চক্রবর্তী ।

দার্জিলিং সুপার মার্কেটের সামনে সারি দিয়ে দাঁড়ানো ট্রেকারগুলোর সামনে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন যে খবরের কাগজবিক্রেতা, তাঁর গতিরোধ করে দাঁড়ালাম আমরা। ‘আপ চাহতে হ্যায় গোর্খাল্যান্ড?’ আপনি গোর্খাল্যান্ড চান? প্রশ্নটা শুনে ঈষৎ বিরক্তি আর অনেকটা বিস্ময় নিয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে ভাঙ্গা হিন্দীতে যা বললেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘গোর্খাল্যান্ড হলে আমাদের একটা মাতৃভমি হবে, তাই না? গোর্খাল্যান্ড তাই আমাদের অধিকার।’ একট এগিয়ে পড়ন্ত বিকেলে মাংসের দোকানের পাশের ঘুপচি গলিটায় ক্যারাম খেলছিল যে দঙ্গলটা, তাদের কাছেও একই প্রশ্ন রাখলাম। প্রথমবার কথা বললো না কেউ, আবার চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম একই প্রশ্ন। একটি জোয়ান ছেলে উঠে এল, সন্দেহের চোখে তাকিয়ে জানতে চাইলো আমাদের উদ্দেশ্য কি। বললাম যে আমরা এই আন্দোলন সম্পর্কে তথ্যচিত্র করতে চাই। কিছুটা সন্দেহ নিয়েই তবু উত্তর দিল সে, ‘অলগ স্টেট হোগা হমারা, গোর্খাল্যান্ড হোগা, তো কোই কিসিকো বাহাদুর বাহাদুর নেহী বোল সাকেগা’। আমাদের আলাদা রাজ্য হলে, গোর্খাল্যান্ড হলে কেউ কাউকে বাহাদুর বাহাদুর বলে ডাকতে পারবে না। কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজের যে কর্মী ট্যুরিস্টদের জন্য মদের পেটি বোঝাই করে শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজে নিয়ে যাচ্ছিলেন, আমাদের সাথে একই গাড়িতে। আমাদের যাত্রার শুরুতে তিনি প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেই গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে গাড়িতে আরো যারা ছিলেন— কলেজছাত্র কিংবা ছোটখাটো ব্যবসায়ী— সবাই ‘বংগাল সরকারের’ বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ উগড়ে দিতে লাগলেন। ‘আমরা তো লাল পার্টি করতাম’, বলছিলেন ঐ ট্যুরিস্ট লজের কর্মী ভদ্রলোক, ‘আমাদের গোটা ফ্যামিলি ছিল সিপিএম, আমার জন্ম, পড়াশোনা, চাকরি সব শিলিগুড়িতে, কিন্তু…।’ আমাদের গোটা সফর জুড়ে আমরা গোর্খাল্যান্ডের পক্ষে প্রশ্নাতীত সমর্থনের সাক্ষী। সরু গলির ছাতা সারাই মিস্ত্রী, টয়ট্রেনের সাফাইকর্মী, ম্যালে ট্যুরিস্টদের হর্স রাইডে নিয়ে যায় যে সদ্য কৈশোর পেরনো ছেলেটি, বাজার ফিরতি গৃহবধ, কনভেন্ট স্কুলের ছাত্রী, হুইস্‌ল্‌ বাজানো ট্রাফিক পুলিশ, চা বাগানের স্টাফ, কানে দুল পড়া স্টাইলিশ যুবক কিংবা জলের কলের সামনে দাড়িয়ে থাকা লম্বা লাইন— সব্বাই সমস্বরে একবাক্যে বলেছেন, তারা গোর্খাল্যান্ড চান। কেউ বলেছেন অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা, কেউ বা ভাষা-সংস্কতির স্বকীয়তার কথা। দীর্ঘশ্বাস আর অভিমানের এই দার্জিলিংকে নিছক বেড়াতে গিয়ে আগে কখনও চিনতে পারিনি— এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।

নিছক আবেগ? হুজুগ? অকারণ ঝামেলা পাকানো? উসকানি? প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা ঘুরেছি পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব ও কর্মীদের কাছে, চা বাগান-সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশনের ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সাথে কথা বলেছি, ছুটে গিয়েছি মালিকী শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র বুকে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন চংথুং চা বাগানের অবসরপ্রাপ্ত সিকিউরিটি গার্ড বাবুরাম দেওয়ান, তাঁর বাড়িতে। সুবিন্যস্ত ঢঙে ইতিহাসের কথা, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর দেউলিয়াপনার কথা, কম্যুনিস্ট পার্টির জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা তোলা এবং পরবর্তীতে গিলে ফেলা— এসবই এসেছে আলোচনায়। কিন্তু আপামর সাধারণ মানুষ মোদ্দা যা বলেছেন তা গভীর প্রত্যয়ের। এক দু পয়েন্টে সংক্ষেপে বললে এরকম—

১) ভারতবর্ষে ১৫টি স্বীকৃত ভাষার মধ্যে উর্দু, সংস্কত আর নেপালি ভাষার কোনও পৃথক রাজ্য নেই। আর সব ভাষারই নিজস্ব রাজ্য আছে। উর্দু ভাষাভাষি মানুষ সারা ভারতে ছড়িয়ে রয়েছে, কথ্য ভাষা হিসেবে সংস্কত’র অস্তিত্ব নেই— তাই এই দুইয়ের ক্ষেত্রে পৃথক রাজ্যের প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু নেপালি ভাষাভাষি মানুষ কেন এই স্বীকৃতি পাবেন না? তাঁরা জানেন যে এর জন্য বহুদুর লড়তে হবে, যেমন লড়তে হয়েছিল নেপালি ভাষার স্বীকৃতির জন্য।

২) এক সময়ের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ঘিসিং, রাজ্য সরকারের সাথে বোঝাপড়া করে যেভাবে দুর্নীতি চালিয়েছে, সেই ঘটনার পুনরাবত্তি যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সচেতনতা এবার অনেক বেশী। ঘিসিং এবং তৎকালীন সিপিএম ’৮৬-র আন্দোলনের সময় যেভাবে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় নিয়োজিত করতে বাধ্য করেছিল পাহাড়ের মানুষকে, সেপথে আবার না চলে যায় এবারের আন্দোলনের গতিপথ, একটা সচেতনতা এব্যাপারেও চোখে পড়ার মত।

৩) দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার শিকার এখানকার মানুষ। এখানকার অর্থনীতি দাঁড়িয়েছিল যে ‘টি, টিম্বার, ট্যুরিজম’-এর ওপর তার আসল ক্ষীরটা খেয়ে নিয়েছে সমতলের ব্যবসায়ীরা— এখানকার মানুষের জন্য পড়ে থেকেছে অবহেলা আর অত্যাচার। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের ন্যনতম সুযোগগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে মানুষ দীর্ঘদিন ধরে। অথচ এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ কিংবা ট্যুরিজম ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছে বাইরের ব্যবসায়ীদের।

কথা বলছিলাম সৌমেন নাগের সঙ্গে। ‘প্রসঙ্গ: গোর্খাল্যান্ড’ এবং ‘উত্তর-পূর্ব ভারত : বিচ্ছিন্নতার উৎস সন্ধানে’ সহ বিভিন্ন বইয়ের লেখক সৌমেনবাবু বলছিলেন দার্জিলিংয়ের ইতিহাস। কিভাবে রাজায় রাজায় যুদ্ধের সুযোগে ইংরেজরা কব্জা করেছিল দার্জিলিংকে। আর তারপর ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যনিবাস হিসেবে গড়ে উঠলো দার্জিলিং শহর, জন্ম নিলো চা বাগান। চা বাগানকে কেন্দ্র করে নেপাল থেকে গরীব-গুর্বো মানুষকে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসা আর অন্যদিকে সমতল থেকে, মলতঃ পূর্ববঙ্গ থেকে শিক্ষিত, জমিচ্যুত জমিদারশ্রেণীর লোকজনের আসা— নানাস্তরের ‘বাগানবাবু’র কাজ করার মধ্যে দিয়ে এক বৈষম্য এবং ফলস্বরূপ এক জাতিসত্ত্বা হিসেবে স্বীকৃতির আকাঙ্খা জন্ম নিল পাহাড়ের নেপালি মানুষের মধ্যে। সেটা ১৯০৭ সাল। পাহাড়ের মানুষের পক্ষ থেকে পৃথক প্রশাসনিক ইউনিটের দাবী উঠল। তারপর একশো বছরে তিস্তায় অনেক জল গড়িয়েছে। তিনি প্রশ্ন তুলছিলেন কেন বন্দুকের ভাষাই এসব ক্ষেত্রে সমাধানের রাস্তা হিসেবে বেছে নিচ্ছে রাষ্ট্র? একট সহানুভতির সাথে কি বিবেচনা করা যেত না এই বিচ্ছিন্ন হতে থাকা মানুষগুলোর ভাবাবেগকে?

পরে খবর পেলাম, সৌমেনবাবুর বই পোড়ানো হয়েছে শিলিগুড়িতে।

কামতাপুর বা গ্রেটার কোচবিহারের ক্ষেত্রে পৃথক জাতিসত্ত্বা হিসেবে তাঁদের দেখতে নারাজ সিপিআইএমএলের সাধারণ সম্পাদক কানু সান্যাল। কিন্তু নেপালি জনগণের গোর্খাল্যান্ডের দাবীর সাথে তিনি একমত। তিনি গিয়েওছিলেন গোর্খাল্যান্ডের দাবীর সপক্ষে অনশনের প্রতি সংহতি জানাতে। তাঁর কৈশোরের স্মতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলছিলেন কিভাবে ১৯৪৩ সালে যখন তিনি কার্শিয়াং-এ স্কুলছাত্র, তখন শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় যোগ দেন গোর্খা লীগের ভলান্টিয়ার হিসেবে। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি তখন গোর্খা লীগের সাথে হাত ধরাধরি করে কাজকর্ম করতো। সেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৫-এ পৃথক গোর্খাস্থান রাষ্ট্রের দাবী তোলে। কানুবাবু অবশ্য সতর্কতা দিচ্ছিলেন যে গোর্খাল্যান্ড হলেও তো সব সমস্যার সমাধান হবে না, শ্রেণীসংগ্রাম থাকবে সেখানেও। তাঁর কাছে যে আন্দোলনকারীরা এসেছেন, তাদের তিনি প্রশ্ন করেছেন যে, কাদের জন্য গোর্খাল্যান্ড? গরীব-মেহনতী-খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কি?

সিপিআরএম-এর সাধারণ সম্পাদক আর বি রাই-এর সাক্ষাতকার নিলাম তাঁদের পার্টি অফিসে। রতনলাল ব্রাহ্মণ ভবন। এটাই এক সময় সিপিএমের পার্টি অফিস ছিল দার্জিলিংয়ে। ‘ পাহাড়ে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে ১৯৪৩-এ। কলকাতা থেকে সুশীল চ্যাটার্জী এখানে আসেন সংগঠন গড়ে তুলতে। একদা টেররিস্ট আন্দোলনের লোক সুশীল চ্যাটার্জী পরবর্তীতে যোগ দেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে, এবং পাহাড়ে এসে রতনলাল ব্রাহ্মণ অর্থাৎ মাইলাবাজে (নেপালিতে শ্রদ্ধেয় সম্বোধনবিশেষ)-র সাথে তার দেখা হয়— পাহাড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস বলছিলেন রত্নবাহাদুর রাই। ১৯৯৬-এ পাহাড়ের সিপিএম থেকে প্রায় পুরোটাই বেরিয়ে এসে তৈরী হয়েছিল সিপিআরএম। সেসময় সিপিএম দার্জিলিং জেলা কমিটির ৪২ জন সদস্যের মধ্যে ২৯ জন ছিলেন পাহাড়ের, যার মধ্যে ২৫ জনই যোগ দেন সিপিআরএমে। একদিকে ’৮৬-র আন্দোলনে জিএনএলএফ-এর সাথে সংঘর্ষে বহু সাথীদের হারানো, তারপর ঘিসিং জমানায় রাজ্য সরকার আর পার্টির রাজ্য কমিটির তরফে পাহাড়ের পার্টিকে টপকে তাদের সেই ঘিসিংয়ের সাথেই নানা অনৈতিক বোঝাপড়া, তারপর ’৯৬ তে দেবগৌড়া তিনটি ছোট রাজ্যের কথা ঘোষণা করলে পাহাড়ের পার্টিকর্মীদের ক্ষোভ আর ধরে রাখা যায়নি। সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে পাহাড়ের পার্টিকর্মীরা যখন জিজ্ঞাসা করলেন যে, এতগুলো ছোট রাজ্য হল, অথচ গোর্খাল্যান্ড কেন হল না, তখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেবগৌড়াকে স্রেফ পাগল আখ্যা দিয়ে পাশ কাটিয়েছিল। আর বি রাই বলছিলেন, একদিকে বাঙালী নেতাদের উগ্র জাত্যাভিমান আর অন্যদিকে সেসময় দার্জিলিং জেলা পার্টির দায়িত্বে থাকা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঔদ্ধত্যের কথা। তিনি অন্যদের মতপ্রকাশ করতে দিতেন না। ‘ঘিসিংয়ের সাথে অনৈতিক বোঝাপড়া ছিল রাজ্য সরকারের। দেদার টাকা পেয়েছে হিল কাউন্সিল, যার কোনও হিসেব নেই। রাজ্য সরকারের থেকে ঐ টাকা পেয়ে ঘিসিং তো আমাদের লোকদের মারার জন্য খরচ করতো। বুদ্ধদাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে বলতো যে টাকা দিয়ে দিয়েই ঘিসিংদের শেষ করবো।’— নির্মম অভিজ্ঞতার কথা শুনছিলাম সিপিআরএমের আর এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গোবিন্দ ছেত্রীর কাছে। এসব শুনতে শুনতে ভাবছিলাম যে এই পার্টির পূর্বসরীরা, রতনলাল ব্রাহ্মণ বা গনেশলাল সুব্বাদের সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিই গোর্খাস্থানের দাবী তুলেছিল। আর বি রাইদের আলোচনা বা সিপিআরএমের আর এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডি এস বোমজানের বইতে ঘুরেফিরে এসেছে কিভাবে অতীতে জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে অতীতে কমিউনিস্টরা ভূমিকা পালন করেছে, কিভাবে সোভিয়েত রাশিয়াতে লেনিন-স্তালিনদের হাত ধরে তা অনুশীলিত হয়েছে, তার অনুপ্রেরণা কিভাবে এখানে কাজ করেছে, আর তারপরে কিভাবে কমিউনিস্ট পার্টি বিচ্যুত হয়েছে সে রাস্তা থেকে। প্রথমে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবী থেকে যাদের শুরু, যার দৌলতে ১৯৪৬-এর নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গে জেতা তিনটি সিটের একটা এই দার্জিলিংয়ে, ১৯৫১ তে তাদেরই ডেলিগেশন টিম রাশিয়া থেকে ফিরে এসে বললো যে আর আলাদা রাষ্ট্র বা রাজ্য নয়, বড়জোর বলা যেতে পারে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা। তারপর ক্রমশ পিছোতে থাকার ইতিহাস। ১৯৮৫ তে পাহাড়ের সিপিএম নেতা আনন্দ পাঠক যখন লোকসভায় দার্জিলিংয়ের স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রস্তাব রাখলেন, তার সমর্থনে সিপিএম-এর সব ভোটও পড়েনি। উল্টে প্রকট থেকেছে বাঙালী জাত্যাভিমান আর ওখানকার মানুষের আশা-আকাঙ্খাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ তকমা লাগানোর চেষ্টা। ‘বামপন্থা কেন, সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে, ইউনাইটেড নেশনসের গহীত মানবাধিকার সনদেও পৃথক রাজ্য বা দেশ গঠনের দাবী করার অধিকার স্বীকৃত অধিকার। একে কখনোই বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা যায় না।’— মানবাধিকার কর্মী এবং শিলিগুড়ি এপিডিআর-এর সম্পাদক অভিরঞ্জন ভাদুড়ির সাথে কথা হচ্ছিল।

বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস শুধু সিপিএম-সিপিআইদের নয়, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পাহাড়ে আইকন হয়ে গেছে সুবাস ঘিসিং ও তাঁর জিএনএলএফ। ’৮৬-র আন্দোলন ছিল ভূমির জন্য, আমরা তার সৈনিক হয়ে খেটেছিলাম। কিন্তু সুবাস ঘিসিং অ্যাকর্ড সই করলো ’৮৮ তে, তারপর আর আমি ঘিসিংয়ের কাছে যাইনি। জিএলএলএফ টিকিট দেয়নি আমায়, কিন্তু জনতা আমাকে ওঠালো’, পাতলেওয়াসে তার বাড়ি ‘পাহাড় কি রাণী’তে বসে বলছিলেন বিমল গুরুং। এখন আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা। ঘিসিংয়ের সাথে তার দূরত্ব আর সান্নিধ্যের অম্লমধুর কাহিনীর বিবরণীর শেষে যখন আমরা জিজ্ঞাসা করলাম যে আপনি যে আর একজন সুবাস ঘিসিং হবেন না, তার গ্যারান্টি কি? আপনি যে আবার ঐ ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ আর আরও একট বেশী ক্ষমতা পেলে রাজ্য সরকারের সাথে সমঝোতার রাস্তায় হাঁটবেন না তার গ্যারান্টি আছে কোনও? এক মূহুর্ত থমকালেন, তারপর হেঁসে বললেন, ‘আমি তো মাটি থেকে উঠেছি।’ আমরা আর এ নিয়ে কথা বাড়াইনি।

আপোষকামিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন মানুষ। যদি দুটি ধারাকেই ধরি, একদিকে জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবী থেকে পিছু হটে যাওয়া সিপিএম নির্মূল হল, বামপন্থী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা প্রবাহিত হল সিপিআরএমের হাতে। অন্যদিকে সুবাস ঘিসিংয়ের জিএনএলএফের আপোষকামিতার বিরুদ্ধে প্রবল আওয়াজ উঠলো— ৭ই অক্টোবর ২০০৭ বিশাল জমায়েতের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠলো গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। জনগণের চাপে বনধ প্রত্যাহার ইত্যাদি নানা বক্তব্য বারবার হাজির করছে বাজারি পত্রিকাগুলো। কিন্তু আমরা যা দেখেছি তা এর উল্টোই, জনগণের চাপে আপোষকামিতার বিরুদ্ধে পুরনো দল ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে সিপিআরএম বা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা; আপোষকামি সিপিএম বা জিএনএলএফের পাহাড়ের ভাঁড়ারকে একেবারে শূন্যে ঠেলে দিয়ে। আর নতুন গড়ে ওঠা দলগুলোকে দ্বিধাহীনভাবে নামতে হয়েছে আন্দোলনের রাস্তায়। জনগণ এবার বেশ সচেতন, একট ভুলচক হলেই নেতৃত্বকে চেপে ধরবে— বলছিলেন সিপিআরএমের দার্জিলিং শহরের এক যুবনেতা। মানুষের সাথে কথা বলে আমাদেরও তাই অনুভতি।

শিল্পায়ন-উন্নয়নের ঢক্কানিনাদের পশ্চিমবঙ্গে, উত্তরের পাহাড়ের কাহিনীও তথৈবচ। চা বাগান বন্ধ রয়েছে অনেক, শ্রমিকদের বকেয়া মেটায় না মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে। সিঙ্কোনা চাষ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প হওয়া সত্ত্বেও ফ্যাক্টরি বন্ধ রয়েছে, ছাঁটাইও হয়েছে প্রচুর। এসবের বিস্তারিত বিবরণী শুনেছি কখনও দার্জিলিং তরাই ডুয়ার্স চিয়া কমান মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কে বি সুব্বা, কখনও সিঙ্কোনা ইউনাইটেড ফোরামের সংগঠক প্রবীণ গুরুংদের কাছে। সিপিআইএমএল লিবারেশনের জেলা সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বিস্তারিত বলছিলেন তরাই-ডুয়ার্স-পাহাড়ের অর্থনীতির হালহকিকৎ। তাঁর কাছেই শুনেছিলাম বাবুরাম দেওয়ানের ঘটনাটা। তাই একদিন সকালে দার্জিলিং থেকে ট্রেকারে চেপে বসলাম চংথুং যাবো বলে। দার্জিলিং থেকে ঘুম হয়ে ডানদিকে মিরিকের রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে আবার গাড়ি চললো বিজনবাড়ির দিকে। সেই পথেই চংথুং চা বাগান। পাহাড়ের ঢালে বিশাল চা বাগানের মধ্যে দিয়ে খাড়া নামতে নামতে চললাম বাবুরাম দেওয়ানদের বাড়ির দিকে। ২০০৫-এর ২৫ শে ফেব্রুয়ারী বাবুরাম দেওয়ান আত্মহত্যা করেন। বাগানের চা মাপার যে ছাউনি, সেখান থেকে ঝুলন্ত দেহটার বুকে আটকানো প্রতিবাদপত্রে লেখা ছিল, ‘এই আত্মহত্যা মালিক অজিত আগরওয়ালের বিরুদ্ধে। আমার পরে এরকম ঘটনা আরও ঘটবে। তাই চংথুং-এর মালিক অজিত আগরওয়ালকে প্রশাসনের দ্রুত সাজা দেওয়া উচিত। একজন লোক ৬৫০০ লোককে অভুক্ত রেখেছে, এটা কিরকম অত্যাচার? প্রশ্ন রইলো প্রশাসনকে। — বি আর দেওয়ান, ২৫/২/২০০৫। বাবুরাম দেওয়ান ছিলেন একজন সচেতন সমাজ-রাজনৈতিক কর্মী। আরও চারজনকে নিয়ে পরপর আত্মহত্যা করে প্রতিবাদ করবেন বলে গোপনে ঠিক করেছিলেন বাবুরাম দেওয়ান। ‘মরণোত্তর চোখ ও দেহদান করেছিলেন বাবা। সমাজসংস্কারক হিসেবে নানা কাজ করতেন, অশিক্ষিতদের স্বাক্ষর করার জন্য প্রাণপন চেষ্টা ছিল তাঁর’— বসতির ঘরে বসে শুনছিলাম লক্ষণ দেওয়ানের কাছে। পাহাড়ের কোলে চা বাগান ঘেরা বসতিটায় চোখে পড়ার মত লাল পতাকা উড়ছে। না, সিপিএম নয়, এটা সিপিআরএমের জন্য। সিপিআর এমের স্থানীয় কর্মী নির্দেশ পরিমল আমাদের বাবুরাম দেওয়ানের কাব্যগ্রন্থ ‘শুভকামনায়ে’ থেকে কবিতা শোনাচ্ছিলেন—

ফুল ফোটায় ঝুপড়ির সারি

ফুল ফোটায় ঝুপড়িরা

ফল ফলায় ঝুপড়িরা

কিন্তু ঝুপড়ির নেই অধিকার ফুলে

গরীবের নেই অধিকার ফলে।

দিনরাত্রি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে

ঝুপড়িরা গড়ে তোলে প্রাসাদ

অথচ সেই প্রাসাদে

ঝুপড়ির ছায়ার প্রবেশ নিষেধ,

নির্মাতার পরিশ্রমী হাতের প্রবেশ নিষেধ।

পাওয়া উচিত ফুলের অধিকার মালির

পাওয়া উচিত ফলের অধিকার মালির

এবার পাওয়া উচিত শ্রমের অধিকার ঝুপড়িদের।

সেই ঝুপড়িতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে শক্তি,

সেই ঝুপড়িতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে বিশ্বাস,

সেই শক্তি আর বিশ্বাস মিলে বিস্ফোরণ ঘটবে একদিন

সেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ঝুপড়িরা।

অত্যাচারই নিয়ে আসে বিস্ফোরণের দিন

অত্যাচারই নিয়ে আসে দিনবদলের দিন

তাই অত্যাচারের ঘড়া ভাঙবে এবার।

শোষণের গ্যাসে ভরা প্রেসার কুকার

অপেক্ষা শুধু বিস্ফোরণের।

অরুণ ঐ অঞ্চলের সংগঠক। তিনি বলছিলেন কিভাবে দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার শিকার ঐ চা বাগান সহ সামগ্রিক অঞ্চলের মানুষ। বাগানের শ্রমিক-কর্মচারীদের সাথে যখন কথা বলেছি যাওয়া আসার পথে, তখনও সেই একই প্রতিচ্ছবি। বাবুরাম দেওয়ানের আত্মহত্যার ঘটনা যেদিনের, সেদিনই তোলা একটা মিনি ডিভি ক্যাসেট হাতে এল। অনেক দৃশ্যের সাথে সাথে একটা স্লোগানে চমকে উঠলাম। ঐ অরুণেরই নেতৃত্বে বাগানের শ্রমিক-কর্মচারীরা স্লোগান তুলছে— ‘ভুখা পেটে রাষ্ট্রভক্তি মানতে পারবো না’— অর্থনৈতিক বঞ্চনার জাঁতাকল থেকে নিষ্কৃতি চান তারা। আর তাই পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবী। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে, সমতলের পুঁজিপতিদের শোষণ-শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে গোর্খাল্যান্ডের দাবীতে আলোড়িত হচ্ছেন পাহাড়ের মানুষ। চা বাগান, সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশন বা বসতি এলাকাগুলোর মেহনতী মানুষের অংশগ্রহণে ব্যাপকভাবে পুষ্ট এবারের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন। অন্যদিকে সমাজের বিদ্বৎজনদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মত।

অর্থনীতি না আইডেন্টিটি? নাকি দুই-ই? চুলচেরা বিশ্লেষণে ঢুকবো না এখানে। কিন্তু আলোড়ণটা যে নিছক হুজুগ নয়, জনগণের চেতনা এবং বাস্তবের এক গভীর আন্দোলন, তা আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট। আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, একদিকে পাহাড়ের সব দল-মত মিলে আন্দোলনের সঠিক রাস্তায় চলতে পারবে কিনা, শাসকরা একজোট হয়েও কতটা ধামাচাপা দিতে পারবে ওখানকার আশা-আকাঙ্খা, তা এখন দেখার। জনগণ লড়াইয়ে সামিল। পৃথক রাজ্য হিসেবে চলার ভঙ্গী রেখে গাড়ির নম্বর প্লেট বদলানো কিংবা টেলিফোন বিল জমা না দেওয়ার মত কর্মসুচীও চলেছে, মিটিং-মিছিল-অনশন-বনধের পাশাপাশি। যদি রাজনৈতিক চাপান-উতোর বা আপোষকামিতার কানাগলিতে হারিয়ে যায় এই আন্দোলন তবে জনগণ কি আবারও তুলে ধরতে পারবে লড়াইয়ের পতাকা? সমবেত জনকন্ঠ কি সোচ্চারে ধরে রাখতে পারবে নিপীড়িত জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আওয়াজকে? উত্তর ভবিষ্যতই বলবে।

যে সময়ে ওই তথ্যচিত্র আমরা বানিয়েছি, আর যে সময়ে এই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে — তার মধ্যে তিস্তা-রঙ্গিত দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ঠিক এই মুহূর্তে কেন্দ্র-রাজ্য-জনমুক্তি মোর্চার ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়ে গেছে এবং পয়তাল্লিশ দিন বাদে আবার আলাপ-আলোচনা হবে এবং সমগ্র বিষয়টিকে রাজনৈতিক স্তরে আলাপ আলোচনায় নিয়ে যাওয়া হবে বলে নির্ধারিত হয়ে রয়েছে।

বিষয়টির দ্রুত নিষপত্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিশেষতঃ তেলেঙ্গানার ঘোষণা এবং তারপর কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের আবার ঢোক গিলে নেওয়া দেখে বলাই যায় ছোট রাজ্যের সম্ভাবনার ‘প্যাণ্ডোরা বাক্স’ খুলে দেওয়াটা সামগ্রিকভাবে কোনো সংসদীয় রাজনৈতিক দলই চাইছে না। অতঃপর গোর্খাল্যান্ড তো এখনও দূর কী বাত। যে সিপিআই তেলেঙ্গানার দাবিকে সমর্থন জানিয়েছে, তারা এখানে গোর্খাল্যান্ডের বিরোধী, যে কংগ্রেসের একটা লবি তেলেঙ্গানা ঘোষণা করে দিচ্ছে, তারাই এখানে বিরোধিতা করছে… তালিকা বাড়তেই থাকবে। মোদ্দা কথা, দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বা সংসদসর্বস্ব বামেরা চিরকালই জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নটিকে বিকৃত করে দেখেছে — ফলে প্রকৃত সমাধান পায়নি মানুষ।

ভারতবর্ষের সংসদীয় আঙ্গিনায় যে দলটি একমাত্র ছোট রাজ্যের তত্ত্বকে কিছুটা স্বীকৃতি দেয়, তারা বিজেপি। হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ভিন্ন ভিন্ন রূপকে অঙ্গীভূত করার আরএসএসসুলভ ভাবনা হোক বা পপুলার ভোটের হিসেব হোক — দুইয়ে মিলে বিজেপি ছোট রাজ্যের পক্ষে। যদিও গোর্খাল্যান্ডকে সমর্থন করার বক্তব্য নিয়ে সমতলে বেশি ট্যাঁ-ফো করেইনি এরাজ্যের বিজেপি। ভোট বড় বালাই। যাই হোক, দার্জিলিং পাহাড়ে গোর্খাল্যান্ডের দাবির স্বপক্ষে মরুভূমির শহর থেকে এলেন যশবন্ত সিং। বিজেপি প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালেন এবং বিপুল ভোটে জিতলেন। পরে যশবন্ত সিং বিতাড়িত হলেন বিজেপি থেকে — সে অন্য কথা। কিন্তু বিজেপির মত ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দলকে ডেকে আনা, জেতানো এবং পাহাড়ের আপামর মানুষকে সে ব্যাপারে মোটিভেট করার কাজটা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা যেভাবে করলো, তা গোলমেলে সংকেত বয়ে নিয়ে আসে। বিজেপির রাজনীতির বাকি ক্লেদাক্ত দিকগুলোকে অন্ধকারে রেখেছে তারা মানুষের থেকে। অন্যদিকে সিপিআরএম-এর মত তথাকথিত বিদ্রোহী বামপন্থী দলও এই প্রশ্নে বিজেপিকে সমর্থন করেছে বা হাওয়ার তীব্রতায় সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে। কিছু খ্রীষ্টান মিশানারী সংগঠন ছাড়া এ প্রশ্নে চোরা কোনও বিরোধী স্রোতও তৈরি হয়নি। গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইনসের খুন খ্রীষ্টান মিশনারীরা মনে রেখেছে অথচ গুজরাটের গণহত্যা, পৃথিবী জুড়ে ফ্যাসিস্টদের হাতে লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী মানুষের খুনের কাহিনী কি করে ভুলে গেলো সিপিআরএম? কি করে আড়াল করলো জনমুক্তি মোর্চা? খুনী ঘাতকদের ডেকে আনার বদলে নিজেদের কোনো প্রার্থীকে জিতিয়ে এনে সংসদে দাবী রাখতে পারতেন না তারা? যশবন্ত বিতাড়িত হওয়ার পর তো কার্যত তাই করতে হচ্ছে। নিজেদের দাবী তুলে ধরার জন্য তাদেরই দৌড় ঝাঁপ করতে হচ্ছে।

বিজেপিকে নিয়ে সমস্যা তো থাকলোই। সমস্যা তৈরি হল আদিবাসীদের সাথে বিরোধ নিয়ে। ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে একই সাথে নেপালি ও আদিবাসী মানুষের বাস। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দাবীর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে সেই দাবীর বিরোধিতা করতে গিয়ে গড়ে উঠেছে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ। মোর্চা-পরিষদ সংঘর্ষও হয়েছে। সিপিএম-আমরা বাঙালি যৌথভাবে সেই সংঘর্ষে ইন্ধনও জুগিয়েছে। কিন্তু এতসবের মধ্যে দিয়ে লাভ হয়েছে এটুকু যে ডুয়ার্সের হতদরিদ্র অসহায় আদিবাসীরা সংগঠিত হয়েছে, নানা দাবী উত্থাপন করছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি কি হয়, সেটা অবশ্যই দেখার। কিন্তু গোর্খাল্যান্ডের মানচিত্রের প্রশ্নে কি সমাধান হবে, কি করে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার দাবী দাওয়ার নিরসন হবে — নাকি গরিব মানুষ জাতিসত্ত্বাভিত্তিক বণ্টনে আরো তীব্রতর জাতিদাঙ্গার দিকে যাবে, এ প্রশ্নও থেকেই যায়।

সর্বোপরি প্রশ্ন আসবে গণতান্ত্রিকতার। পুরনো বহু জাতিসত্ত্বার আন্দোলন খতম হয়েছে সেই জাতিসত্ত্বার উপরের অংশের ক্ষমতায়নের মধ্যে দিয়ে বা তাদের সাথে শাসকদের সমঝোতার মাধ্যমে। কখনো অর্থ, কখনো পদ, কখনো ক্ষমতার টোপ নেতৃত্বকে বিচ্যুত করেছে আন্দোলনের প্রকৃত রাস্তা থেকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে চলা নিপীড়িত জাতিসত্ত্বার লড়াইগুলোর তুলনায় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন নিশ্চয়ই প্রাণবন্তভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সংগ্রামী মেজাজও নিশ্চয়ই নজর কাড়ে। কিন্তু বিভিন্ন প্রশ্নে গণতান্ত্রিক বাতাবরণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিচ্যুতি লক্ষ্যণীয়। আন্দোলনের নানারূপ সম্পর্কে জনগণের বিভিন্ন অংশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, আন্দোলনের নানা অংশীদারদের হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা এবং আন্দোলনকারী শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতার সন্ধানে এসে পড়া সুযোগ সন্ধানীদের নানা দুর্নীতি আন্দোলনকে বিপথগামী এবং কালিমালিপ্ত করবে।

প্রকৃত বামপন্থীরা মেহনতী মানুষের ঐক্যকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলে। নেপালে বিপ্লবী বামপন্থী শক্তির আহ্বানে এধরনের জাতিসত্ত্বাভিত্তিক রাজ্য ঘোষণার কর্মসূচী চলছে, যদিও এ বিষয়ে আরো পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এরকম একটা অবস্থায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি আরো বেশি চর্চায় আসা উচিত, এ প্রশ্নে অধিকারের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। গোর্খাল্যান্ডের মত প্রাণবন্ত আন্দোলন সেই বার্তাকে সমাজে হাজির করাক, তার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে — যে কোন মুক্তিকামী শক্তির মত আমাদেরও তাই আশা।